ভারতের কেরালা রাজ্যের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান - Bangla Travel

ভারতের কেরালা রাজ্যের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান

কেরালার ইতিহাস এর বাণিজ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত যা সাম্প্রতিক সময়কাল পর্যন্ত মশলার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত। ভারতবর্ষের মশলা উপকূল হিসেবে খ্যাত কেরালা অতীতে গ্রীক, রোমান, আরবীয়, চীনা, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসী এবং ইংরেজ পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের জন্য ভারতের অতিথি সেবকের ভূমিকা পালন করত। এঁরা সকলেই কোন না কোন রূপে এই রাজ্যে তাঁদের পদচিহ্ন রেখে গেছেন, তা সে স্থাপত্যকীর্তি, রন্ধনশিল্প বা সাহিত্য যে ক্ষেত্রই হোক

কোভালাম
দক্ষিণ কেরালার থিরুবনন্তপূরম থেকে মাত্র 16 কিমি। কোভালম একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমুদ্র সৈকত, যেখানে একটি-অপরটির সঙ্গে লাগোয়া তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার বেলাভূমি রয়েছে। এই সমুদ্র সৈকত সেই 1930-এর দশক থেকেই বরাবর পর্যটকদের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে, বিশেষত ইউরোপীয়দের কাছে। এই সৈকতে একটি ভীমকায় পাথুরে শৈলান্তরিপ রয়েছে যা একে সমুদ্রস্নানের পক্ষে আদর্শ একটি শান্ত-স্নিগ্ধ সৈকতের রূপদান করে।

নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন: থিরুবনন্তপূরম সেন্ট্রাল, প্রায় 16 কিমি দূরে। নিকটতম বিমানবন্দর: থিরুবনন্তপূরম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, প্রায় 10 কিমি দূরে।

ফোর্ট কোচি
ফোর্ট কোচির ঐতিহাসিক শহরটিকে ভালভাবে দেখার সেরা উপায় হচ্ছে পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে পড়া। আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে ইমানুয়েল দুর্গ। এই দুর্গ-প্রাসাদটি অতীতে পর্তুগীজদের আস্তানা ছিল এবং কোচির মহারাজা সঙ্গে পর্তুগালের সম্রাটের বন্ধুত্বের প্রতীক ছিল, যাঁর নামেই এর নামকরণ। এই দুর্গ-প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল 1503 সালে ।
প্রাচীন ঠাকুর হাউস, যেটি ঔপনিবেশিক যুগের একটি কংক্রিট স্থাপত্য। আছে ডেভিড হল। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা এটি আনুমানিক 1695 সালে নির্মিত। হলটি খ্যাত নামা ওলন্দাজ সেনাপতি হেনড্রিক অ্যাড্রিয়ান ভ্যান রীড টট ড্র্যাকেস্টনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখানকার বিখ্যাত প্যারেড গ্রাউন্ড, যে প্যারেড ময়দানে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও ব্রিটিশ প্রত্যকেরই সৈনবাহিনী কুচকাওয়াজ করত। 1503 সালে পর্তুগীজ শাসকদের দ্বারা নির্মিত একটি রয়েছে। এ গির্জা বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাক্ষী থেকেছে। এই গির্জাতেই ভাস্কো দা গামা সমাহিত হয়েছিলেন। আরো পুরাতন বেশকিছু গির্জা রয়েছে পূর্তগীজ আমলের। 1740 সালে নির্মিত এই বিশাল দরজাটির নামকরণ ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মনোগ্রাম (VOC) অনুসারে করা হয়েছিলন। এটাও দেখার মতো। 1506 সালে নির্মিত একটি ভবন যা একদা পর্তুগীজ গভর্ণরের বাসভবন ছিল এবং এটি কুচকাওয়াজ ময়দানের নিকটস্থ একটি টিলার উপর নির্মিত হয়েছিল। ভবনের সম্মুখভাগে বিশালাকার গথিক খিলান রয়েছে। ৫শ বছরের পুরনো শহরে মুহর্তে আপনাকে নিয়ে যাবে সে পুরনো দিনগুলোতে।

আলুঝোপ্পা
প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত আলাপ্পুঝা চিরকালই কেরালার উপকূলকেন্দ্রিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে এসেছে। বর্তমানে, এই স্থানটি এখানকার নৌচালন প্রতিযোগিতা, ব্যাকওয়াটার অবসরযাপন, সমুদ্র সৈকত, সামুদ্রিক পণ্যসামগ্রী এবং ছোবড়া শিল্পের জন্য বিখ্যাত। আলাপ্পুঝা বেলাভূমি একটি উত্তম পিকনিক করার জায়গায়ও বটে। সমুদ্রের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাওয়া এখানকার জেটিগুলি 137 বছরের পুরনো। সৈকতকেন্দ্রিক বিনোদনের সুবিধার মধ্যে বিজয়া সৈকত উদ্যান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়াও অনতিদূরে স্থিত লাইটহাউসটিও পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের বিষয়।
নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন: আলাপ্পুঝা, সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় 5 কিমি দূরে। নিকটতম বিমানবন্দর: কোচিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আলাপ্পুঝা শহর থেকে প্রায় 85 কিমি দূরে।

বেকাল
বেকাল দুর্গ থেকে কম-বেশি এক কিলোমিটার, আর উত্তর কেরালার কাসারগোদ জিলার জাতীয় সড়কের উপর দক্ষিণ কাসারগোদ থেকে মোটামুটি 16 কিমি দূরত্বে স্থিত।

উত্তর কেরালার প্রান্তিক জিলা কাসারগোদ দুর্গ, নদী, পাহাড়, সুন্দর সমুদ্র সৈকত ও অসংখ্য দেব-দেবীর ভূমি হিসেবে পরিচিত। বেকালের মনোরম দুর্গটি কেরালার সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত দুর্গ। বেকাল দুর্গের অনতিদূরে স্থিত অগভীর সমুদ্র সৈকতটির নাম বেকাল দুর্গ সৈকত, যা বেকাল পর্যটন উন্নয়ন নিগন (BRDC) কর্তৃক বিকশিত একটি বিলাসবহুল সমুদ্র সৈকত।

কুমারকম
কুমারকম গ্রামটি ভেম্বানদ সরোবরের উপর ভেসে থাকা একটি ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ, এবং কুট্টানদ অঞ্চলের অন্তর্গত একটি স্থান। এখানকার পাখিরালয়, যা 14 একর অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে, পরিযায়ী পাখিদের একটি প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র এবং পক্ষীবিজ্ঞানী তথা পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। বক, গয়ার, হেরন, বালিহাস, পানকৌড়ি, কোকিল, বুনোহাস এবং পরিযায়ী পাখি যেমন সাইবেরীয় সারস ইত্যাদি ঝাঁকে-ঝাঁকে এখানে আসে এবং পর্যটকদের মুগ্ধ করে দেয়। কুমারকমের পাখি দেখার সব থেকে ভাল পদ্ধতি হচ্ছে একটি নৌকোয় চড় এই গোটা দ্বীপপুঞ্জটির এক চক্কর দিয়ে নেওয়া।

বিমোহিতকারী এই পর্যটক গন্তব্যস্থল কুমারকম পর্যকটকদের আরও অন্যান্য অবসরবিনোদনের সুযোগ করে দেয়। তাজ গার্ডেন রিট্রীট-এ নৌভ্রমণ ও মাছ ধরার সুযোগ রয়েছে, যা পর্যটকাবাসে রূপান্তরিত হওয়া একটি প্রশস্ত সাবেক বাংলো।

মুন্নার
মুথিরাপুঝা, নাল্লাথান্নি এবং কুন্দলা এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 1600 মিটার উচ্চতায় স্থিত মুন্নার শহরটি ছিল তদানীন্তন দক্ষিণ ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের গ্রীষ্মকালীন ঘাঁটি।

বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে চা বাগান, ঔপনিবেশিকালের সব বাংলো, ছোট ছোট নদী, জলপ্রপাত এবং শীতল আবহাওয়া, এই সবই এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যাবলী। এছাড়াও ট্রেকিং ও মাউন্টেন বাইকিংয়ের জন্য এটি একটি উপযুক্ত স্থান।
মুন্নারের কাছে ইরাভিকুলম জাতীয় উদ্যানের মধ্যে স্থিত শৃঙ্গের নাম আনামুদি শৃঙ্গ। এটি দক্ষিণ ভারতের পর্বতগুলির মধ্যে উচ্চমত পর্বতশৃঙ্গ যার উচ্চতা 2700 মিটারের কিছু বেশি। এই শৃঙ্গে আরোহণের জন্য ইরাভিকুলমের বনবিভাগ ও বন্যপ্রাণ কর্তৃপক্ষের থেকে আগাম অনুমতি নিতে হয়।

থেক্কাডি
থেক্কাডি শব্দটি শুনলেই যেন হাতির পাল, অসংখ্য পাহাড়ের সারি এবং সুগন্ধে ভরপুর মশলার বাগানের ছবি চোখের সামনে এসে হাজির হয়। থেক্কাডির পেরিয়ার বনাঞ্চলে রয়েছে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভয়ারণ্য এবং প্রায় সমগ্র জিলা জুড়ে বিস্তৃত ছবির মতো সুন্দর চা-বাগান এবং শৈলশহরগুলি ট্রেকিং ও পর্বতচারণের জন্য বিশেষ উপাদেয় স্থান।

কুমিলি থেকে (4 কিমি দূরে স্থিত) বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যগুলির জন্য ঘন ঘন বাস পরিবহন পরিষেবা চালু আছে।

ওয়েনাদ
পশ্চিমঘাট পর্বতমালার শীর্ষদেশে 2,132 বর্গকিমি জুড়ে বিস্তৃত জৈব-বৈচিত্রতাপূর্ণ ওয়েনাদ কেরালার একটি দর্শনীয় জিলা যা আজও তার আদিম সৌন্দর্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এখানকার পাহাড়গুলির আড়ালে এখানকার কিছু প্রাচীনতম আদিবাসীদের বসবাস, যাঁরা আজও আধুনিক সভ্য জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আর কেরালায় ইদাক্কাল পাহাড়ের পাদদেশে ও আম্বুকুথিমালার আশে-পাশে যে সমস্ত প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রগুলির সন্ধান পাওয়া গেছে। ওয়েনাদের দক্ষিণ প্রান্তের মেপ্পাদির নিকটে 2100 মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চেম্ব্রা শৃঙ্গ।
ব্রক্ষ্মগিরি বনাঞ্চলের মধ্যে 1700 মিটার উচ্চতায় অবস্থিত পক্ষীপথলম। এই অঞ্চলি জুড়ে বড় বড় পাথর ছড়িয়ে রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি তো সত্যিই অতিকায়। চেথালয়ম ওয়েনাদের আরও একটি জলপ্রপাত যা দর্শকদের আকর্ষণ করে তা হল চেথালয়ম জলপ্রপাত। এটি উত্তর ওয়েনাদের সুলতান বাথেরির খুব কাছেই আবস্থিত। মীনমুত্তির তুলনায় এটি কিছুটা ছোট আকারের জলপ্রপাত। জলপ্রপাত ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলটি ট্রেকিং ও পক্ষীপ্রেমী মানুষদের জন্য আদর্শ স্থান।

ভারকালা
ভারকালার স্নিগ্ধ সমুদ্র সৈকত একটি একটি খনিজ পদার্থপূর্ণ প্রস্রবণ সমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্যস্থল। এখানকার সমুদ্রের জলে একটি ডুব দিলেই তা সমস্ত শরীরকে দূষণমুক্ত ও আত্মাকে পাপমুক্ত করে বলে বলে লোকের বিশ্বাস; এই কারণেই তো এই সৈকতের স্থানীয় নাম ‘পাপনাশম সৈকত’।

সৈকত থেকে কিছু দূরে উঁচুতে তাকালে একটি টিলা দেখা যাবে যেখানে একটি হাজার বছর প্রাচীন জনার্দনস্বামীর মন্দির দেখা যাবে। এখান থেকে অনতিদূরে অবস্থিত মহান হিন্দু সংস্কারবাদী ও দার্শনিক শ্রী নারায়ন গুরু (1856-1928) দ্বারা স্থাপিত শিবগিরি মুত্ত। প্রতি বছর 30শে ডিসেম্বর থেকে 1লা জানুয়ারি পর্যন্ত চলা উৎসব শিবগিরি তীর্থযাত্রী দিবসে এখানে রাখা গুরুর সমাধিতে (অন্তিম শয্যা) তাঁর হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়।

জটায়ু পার্ক
কেরালার পর্যটনে নয়া মাত্রা যোগ করতে তৈরি জটায়ু পার্ক। ৬৫ একর জায়গায় তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম পাখির ভাস্কর্য খুলে দেওয়া হবে সামনের বছর জানুয়ারিতে। আরাও নানা অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানিও থাকছে পৌরাণিক বিশ্বাসে ভর করে তৈরি এই জটায়ু পার্কে।

রামায়ণে কথিত রয়েছে জটায়ু পাখির কথা। সীতাহরণের মুহূর্তে রাবণকে জটায়ুর চরম প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল। তবে, অবশেষে হার মানতে হয় জটায়ুকেই। রাবণের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঠিক যেখানে জটায়ু ভূপতিত হয়েছিল, সেই চাডায়ামঙ্গলমেই নাকি তৈরি করা হয়েছে জটায়ু পার্ক। তবে এই পার্কের মূল আকর্ষণ হল জটায়ু পাখির বিশাল ভাস্কর্য। ২০০ ফিট দীর্ঘ, ১৫০ ফিট প্রস্থ ও ৭০ ফিট লম্বা এই শিল্পকীর্তি পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম পাখির ভাস্কর্য। ১৫,০০০ বর্গফিট জায়গার উপর তৈরি এই বিশাল জটায়ু তৈরি করেছেন চিত্রপরিচালক রাজীব অঞ্চল। খুব শিগগিরই রিনিউয়েবল এনার্জি ও রেনওয়াটার হারভেস্টিং-এর বিশেষ সহযোগী হয়ে উঠতে চলেছে কেরালার এই জটায়ু পার্ক।
পশ্চিমে আরব সাগর, পূর্বে 500-2700 মিটার উচ্চ পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দ্বারা এবং 44টি নদী-জাল বেষ্টিত কেরালা রাজ্যটি বহুমূখী ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে মোড়া। সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গরাজি এবং গভীর উপত্যকা থেকে শুরু করে অনন্ত ব্যাকওয়াটার ও সুবিস্তৃত তটভূমি নিয়ে কেরালা রাজ্যের কাছে নেই বলে কিছুই নেই।

 সূত্র: www.keralatourism.org,
ভারতের কেরালা রাজ্যের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভারতের কেরালা রাজ্যের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান Reviewed by BANGLA TRAVEL on 16:13 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.